তুষারদা: শুধু লাল নয়,  নানা রঙের বাজারের কারবারি

রামকুমার মুখোপাধ্যায়

তুষার তালুকদারের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রধান সূত্রটি হলো বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির।  তুষারদার দেড় দশকের‌ও পরে আমি সেখানে ভর্তি হ‌ই।  ততদিনে  আগের সময়ের কোনো সাধু বা অধ্যাপক ছিলেন না।  ফলে আমি  তুষারদার সতীর্থ‌ও ন‌ই। তবে আবাসিক এবং আকারে ছোটো কলেজ বলে  পুরোনো আমলের অনেক ছাত্রের কথা  পরম্পরার সূত্রে মৌখিক আখ্যানের মতো কলেজ ও হস্টেলে ঘুরে বেড়াত।  কোন ছাত্র সারা সন্ধে বন্ধুদের পড়াশোনা ঘেঁটে দিয়ে, নিজে মাঝরাত থেকে ভোর পর্যন্ত পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায়  প্রথম তিনের  মধ্যে ছিলেন তা জানতাম।  শুনতাম কোন দাদা কলেজের ফুটবল দলের  অসাধারণ লেফট আউট ছিলেন আর কর্নারের বল  সুইং করিয়ে প্রতিপক্ষের  জালে জড়িয়ে দিয়েছিলেন।  কোন দাদা ভালো গান গাইতেন, কে ভালো কবিতা লিখতেন, কে ভালো অভিনয় করতেন, কে কলেজের পুকুরে কত ভালো সাঁতার কাটতেন, কে মাংসের দিন রাতে কতগুলো রুটি খেতেন,  সে সব‌ও জানা হয়ে গিয়েছিল।  কে কে  কোন গোপন পথ দিয়ে রবিবার দুপুরে সালকিয়া বা বালিতে সিনেমা দেখতে যেতেন,  তাও অজানা ছিল না। সে পথের ভাঙা ইট  জুড়ে দিলেও  সামান্য দূরে কলাবাগানের পিছনে নতুন পথ তৈরি হয়ে গিয়েছিল আর পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য উত্তরসূরিরা বর্ষে বর্ষে বহন করত। 

          এসব কারণে তুষার তালুকদারের সঙ্গে সময়ের দূরত্ব থাকলেও  ঘরানা ও ধারবাহিকতায় একটা অদৃশ্য যোগ ছিল।  সে যোগ আর‌ও  শক্ত হয়  ১৯৭৪-৭৫ সাল নাগাদ  প্রাক্তনীদের পুনর্মিলনের  উদ্যোগে। প্রাক্তনীরা কোনো কোনো সময়ে কলেজে বেড়াতে আসতেন, কখন‌ও বিশেষ কোনো উৎসবে কাউকে আমন্ত্রণ করে আনা হত  কিন্তু পুনর্মিলন  উৎসব সেভাবে হত না। অনেক আগে দু-চারবার হয়ে থাকতে পারে কিন্তু ছয়ের দশকের শেষ ও পায়ের দশকের শুরুতে নকশাল আন্দোলনের ফলে সব‌ই বাদ পড়ে যায়। আমাদের সময়ে তা নতুন করে ফিরিয়ে আনা হয় ।  সেই সূত্রে পুরোনোদের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ তৈরি হয়। আমার দেখা সেটাই ছিল প্রথম  পুনর্মিলনের  অনুষ্ঠান।  শুরু হয়েছিল ভোরে  শ্রীভবনে প্রার্থনা দিয়ে আর  শেষ হয়েছিল রাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তুষার তালুকদার এসেছিলেন কিনা মনে নেই তবে তাঁর  আসার কথা। এর কারণ তুষারদার  সময়ের বন্ধুদের পারস্পরিক বেশ যোগ ছিল আর তা তাঁরা লালন‌ও করতেন।  শ্যামল চৌধুরী, চন্দ্রনাথ দে, কল্যাণ বসু, বিশ্বনাথ দাসের মতো কয়েকজন উৎসাহী প্রাক্তনী  এক‌ই বছরের  বা সামান্য আগে পরের।  প্রাক্তনীদের পুনর্মিলন উৎসবে দুপুরে খাওয়ার পরে একটা সভা হত পুরোনো কালের কথা বলার জন্যে।  তাতে  প্রত্যেক শিক্ষাবর্ষের প্রাক্তন ছাত্রেরা বলতেন।  আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা নয়,  বৈঠকী আড্ডার মতো। সেখানে তাঁরা নিজেদের সময় ও  বন্ধুদের কথা বলতেন।  সেই সূত্রে  তুষারদার কথা আসত , বিশেষ করে সে সময়ের অধ্যক্ষ স্বামী তেজসানন্দের প্রসঙ্গ উঠলে। তেজসানন্দজি বিশেষ স্নেহ করতেন তুষারদাকে,  নিশ্চয় কিশোরটির বিশেষ কিছু গুণের কারণে। 

      তুষারদার জীবনেও মহারাজের ছাপ পড়েছিল।  পরবর্তী সময়ে বলেছেন যে,  তেজসানন্দের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যা অন্য কোনো সাধু, গৃহী বা শিক্ষকের মধ্যে  দেখেননি। ছাত্ররা পড়াশোনা করছে কিনা— এটুকু দেখাই শুধু নয়, তারা খেলছে কিনা, থিয়েটারে রিহার্সালে ঠিক সময়ে আসছে কিনা,  গান গাইলে ঠিক গানটা গাওয়া হচ্ছে কি না—  এই সব দিকেই শুধু যে তাঁর নজর ছিল যা নয়, তিনি ইনভলভড্  ছিলেন।  তেজসানন্দজি সম্পর্কে তুষারদা এই যে ইনভলভড্ থাকার কথা বলছেন,  এটা তাঁর নিজের জীবন ও কর্মেও ঘটেছিল বলে মনে হয়।  যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন এবং কাজে সঙ্গ দিয়েছেন,  তাঁরা আর‌ও ভালো বলতে পারবেন।  তেজসানন্দজি সম্পর্কে আর‌ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। কোনো ছাত্রকে হয়তো কঠোর শাস্তি দিয়েছেন,  বিদ্যামন্দির থেকে বাড়িই পাঠিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তারপরেও ছাত্রদের জিজ্ঞেস করতেন তিনি বেশি কঠোর হয়ে গেছেন কিনা। কেউ শাস্তি বেশি হয়ে গেছে বললে বলতেন, বাবা-মায়েরা পড়াশোনার সঙ্গে  কিছু চালচলন ও আচার-আচরণ শেখাতে মিশনে পাঠান যা ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে দেয়।  তাই কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।  তুষার  তালুকদার আর‌ও বলেছেন যে, এই কঠোরতা  শুধু কঠোরতার জন্যেই নয়— সেটা আলোচনা সাপেক্ষ‌ও হতে পারে— এটা তাঁর কাছে খুব গণতান্ত্রিক মনে হয়েছে। অধিকাংশ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগঠনে এটা মেলে না। ভিন্ন মতের  প্রতি তেজসানন্দের  আগ্রহ ও উদারতার  আর‌ও কিছু  উদাহরণ দিয়েছিলেন।  তার একটা ছিল, সে সময়ের বাংলার অধ্যাপক শীতলপ্রসাদ ভট্টাচার্য বিষয়ে।  তিনি অনেক সময়  ক্লাসে মার্কসবাদ এবং তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করতেন।  সময়টা গত শতকের পাঁচেক দশকের মাঝামাঝি,  যার সামান্য কয়েক বছর আগে এখানের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। আর কলেজটিও  রামকৃষ্ণ মিশন  পরিচালিত যেখানের  ছাত্রদের ধর্মপ্রাণ হ‌ওয়া একান্ত দরকার বলে কেউ কেউ মনে করতেন।‌ তাঁরা তেজসানন্দজির কাছে শীতলবাবুর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ পড়িয়ে ছাত্রদের বিপথে চালিত করার অভিযোগ আনলেন আর শীতলবাবুর বিদায় আসন্ন বলে অনেকেই মনে করলেন। অধ্যক্ষ তেমন কোনো পদক্ষেপ‌ই নিলেন না।  বরং বললেন, উনি মাস্টারমশাই। ওঁনার যদি মনে হয়  যে কোনো-কিছু বোঝাতে গেলে এটাও বোঝানো দরকার — ওটা জানলেই-বা ক্ষতি কী?  ওটা জানাই তো উচিত। কতরকম চিন্তাধারাই আছে— জানা দরকার।

      ভিন্ন মতের প্রতি এই সহনশীলতা তুষার তালুকদারের‌ও ছিল। পাঁচজনের কথার  মাঝে নিজের কোনো একটা মতকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকতেন না। বরং সবার মতামতের মধ্যে যেটা সবচেয়ে ভালো মনে হত, সেটাই মেনে নিতেন। মনের দরজা-জানলা খোলা রাখলেই এটা সম্ভব। আর একটা বিষয়ও বেশ ভালো লাগত।  তিনি বেশ আধুনিক মানুষ ছিলেন। সে কারণে আগের বা পরের প্রজন্মের মানুষজনের সঙ্গে কোনো জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়নি।  আমাদের মতো যারা কম বয়েসের তাদের কথাও মন দিয়ে শুনতেন।  আবার মহাশ্বেতা দেবীদের মতো যাঁরা  তাঁর থেকে বয়েসে বেশ খানিকটা বড়ো, তাঁদের সঙ্গেও তেমন‌ই সহজভাবে মিশতেন। শুধু উপরের দিকে শ্রদ্ধা আর নীচের দিকে স্নেহের একটা ছোঁয়া লেগে থাকত। বেশি কথা বলতেন না কিন্তু কথার মধ্যে চিন্তার স্বচ্ছতা প্রকাশ পেত আর স্বরের মধ্যে ব্যক্তিগত এক স্পর্শ।

         গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তনী সংসদ তার কাজের পরিধি  বেশ খানিকটা বাড়ায় ।  কিছু সামাজিক প্রকল্প হাতে নেয়। এর মধ্যে বিভিন্ন জেলাকে জড়িয়ে বিবেকানন্দ সম্মেলন, দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা, দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান, চক্ষু অপারেশনের ক্যাম্প‌ ইত্যাদিও ছিল। ১৯৯১ সালে বিদ্যামন্দিরের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালিত হয়। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ভূতেশানন্দ ৪ জুলাই পঞ্চাশটি প্রদীপ জ্বেলে তার সূচনা করেন।  তারপর এক বছর ধরে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তা উৎযাপিত হয়। সেবার প্রাক্তনীদের পুনর্মিলন উৎসব‌ও  বেশ বড়ো ভাবে আয়োজন করা হয়েছিল। তুষারদা প্রাক্তনী সংসদের কাজে তখন অনেকখানি যুক্ত হয়েছেন। প্রাক্তনী সংসদের সভায় পরামর্শ দিচ্ছেন রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে একটা কেরিয়ার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হোক ।  সেখানে ছেলে এবং মেয়েরা  কী পড়বে, কেমনভাবে তৈরি হবে এবং কোথায় কাজের সুযোগ মিলবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাবে। এও বলেছিলেন যে, আই.  এ. এস ও আই. পি.  এস পরীক্ষায় কয়েক বছর আগে নানা পরিবর্তন করা হয়েছে। যদি কেরিয়ার ইনস্টিটিউট তৈরি করা হয়, তাহলে সদ্য যাঁরা ওই সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন  তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন। ১৯৯৩ সালে ৪ জুলাই প্রাক্তনী সংসদের পক্ষ থেকে মানিকতলা ক্যানাল ইস্ট রোডের বাসিন্দাদের জন্যে একটি ক্লিনিক, শিক্ষা সহায়ক কেন্দ্র ও বুকব্যাঙ্ক খোলা হয়। ওই কাজটিতে তুষারদা বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন।

              আসলে তুষারদা বিশ্বাস করতেন যে, শুধু রিভলবার তুলে  বা অপরাধীদের  জেলে ভরে সামাজিক অপরাধের স্থায়ী সমাধান হবে না। প্রয়োজন অপরাধের অন্ধকার উৎসগুলিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার সুযোগ তৈরি  করা । তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের পরামর্শে তুষার তালুকদার কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে খিদিরপুর অঞ্চলে একটা সমীক্ষা চালান।  দেখেন সেখানে বেশ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।  সংস্কারের জন্যে একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন কিন্তু রাজ্যপাল প্রথমে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরে  রাজ্য ছেড়ে  চলে যান। সে কাজ আটকে যায়।

        আমাদের  প্রাক্তনী সংসদের   পক্ষ থেকে ‘ বিদ্যামন্দির প্রাক্তনীবার্তা’ নামে একটি নিউজ লেটার প্রকাশ করা হত।  সুবর্ণজয়ন্তীর  সময়ে সে পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে আমাকে যুক্ত করা হয়।  আমি তখন সাহিত্য অকাদেমিতে সম্পাদনার কাজ করি  আর অকাদেমির ব‌ইপত্র  ও পত্রপত্রিকা সব‌ই বড়ো আর মোটা আকারে প্রকাশ পায়।  ‘বিদ্যামন্দির প্রাক্তনীবার্তা’কেও তথ্যপত্র থেকে পত্রিকায় রূপান্তর ঘটাই। প্রাক্তনীদের স্মৃতিচারণ,  বিশেষ কোনো বিষয়ে প্রবন্ধ,  প্রাক্তনীদের লেখা ব‌ইয়ের আলোচনা প্রকাশ করতে থাকি। ১৯৯৪ সালে বিদ্যামন্দিরের সে সময়ের ছাত্রেরা তুষারদার একটি  সাক্ষাৎকার নেয়। যতদূর মনে পড়ে কলেজের  বিবেকানন্দ সভাঘরে সেটি হয়েছিল। বেশ কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র‌ও ছিলেন। ‘বিদ্যামন্দির প্রাক্তনীবার্তা’র ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় সেটি প্রকাশিত হয়েছিল।  তুষারদার আর একটি বড়ো সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রাক্তনীবার্তা’র এপ্রিল ১৯৯৯  সংখ্যায়।  সেটি আমার সহপাঠী গৌতম গোস্বামীর সঙ্গে আমি নিয়েছিলাম। দুটি সাক্ষাৎকার এবং পরবর্তী সময়ের কথাবার্তা থেকে  তুষার তালুকদারের   দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিচয় পেয়েছিলাম।  বাড়ি পূর্ববঙ্গে হলেও বাবার কর্মসূত্রে আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গে থাকতেন। ফলে দেশবিভাগের সঙ্কটে পড়তে না হলেও চারের দশকের দুর্ভিক্ষ দেখেছেন। মায়ের দেওয়া একটা রুটি দরজার সামনে দিতে গিয়ে দেখেছেন চোখের সামনে অনেকগুলো হাত উঠে আসতে।  বিদ্যামন্দির থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হন কিন্তু বাবা বলেন পাঁচ বছরের খরচ টানা কঠিন হবে। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হ‌ওয়া।  রেজাল্ট বেরোনোর পরে-পরেই একদিন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে শুনলেন যে আই. এ. এস ও আই. পি. এস পরীক্ষার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আবেদন করলেন, পরীক্ষা দিলেন আর চাকরিও পেয়ে গেলেন।‌

        শক্ত অফিসার ছিলেন। আসানসোল  এস. ডি . পি.  ও পদে যোগ দিয়েছেন।  সেখানকার এক মাফিয়া তখন পুলিশের ত্রাস। তিনি প্রথম তাকে জেলে ঢোকালেন কিন্তু এরা তো বেরিয়ে আবার অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। আবার কিছুদিন জেলে থেকে বাইরে স্বমূর্তি ধারণ করে। তুষার তালুকদার ওই  শুধু যাওয়া-আসার গল্পে ঢুকলেন না। একদিন মাঝরাতে জেল থেকে ওই মাফিয়াকে  বার করে গাড়িতে করে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে যান। তারপর গাড়ি থেকে নামিয়ে বুকের দিকে রিভলবার তুলে বলেন,  ‘তোর সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে।  আমি যতদিন এ সাব-ডিভিশনের এস. ডি. পি. ও থাকব, তুই এখানে কোনো অপরাধ করতে পারবি না। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে তুই বদলাবি না। তাহলে এই রিভলবারের একটা গুলিতে তোকে আজ এখানেই মেরে দেব।  বলে দেব জেল থেকে তালা ভেঙে পালাচ্ছিল। তাড়া করে মারা হয়েছে।’  তুষার তালুকদারের আসানসোল পর্বে সে আর কোনো গোলমাল করেনি।

       দ্বিতীয় ঘটনাটা তুষার তালুকদার ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে থাকার সময়ে। একদিন খবর পেলেন ঝাড়গ্রামের একটা গ্রামে একজন সাঁওতাল তার ব‌উকে খুন করেছে।  তুষার তালুকদার সেখানে গেলেন। শুনলেন কাজ খুঁজতে গিয়ে কাজ না পেয়ে দুপুরে ঘরে ফিরে খাবার চায় আর ব‌উ খেতে দিতে না পারায় চড় মেরে ঠেলে ফেলে দেয়।  তাতেই  খাবারের অভাবে শীর্ণকায় ব‌উ পড়ে মারা যায়। তুষারদা তারপর গ্রামটি ঘোরেন আর শোনেন যে, ওখানকার মানুষজন বছরে চার মাস কাজ পায় আর তাতে ছ-মাস চলে। বাকি সময় গাছের এক ধরনের ফল সেদ্ধ করে খায়। চাকরি জীবনের শুরুতেই এমন এক সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে চমকে ওঠেন। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক তথ্য যোগ করে তুষার তালুকদার এমন একটা রিপোর্ট তৈরি করেন যাতে ওই মহিলার মৃত্যুর প্রধান কারণ অপুষ্টি  বলে প্রকাশ পায়।  এছাড়া অন্য কিছু করলে পুরুষটি দীর্ঘকাল জেলে থাকত আর বাচ্চা তিনটে বাঁচত কিনা সন্দেহ। এও ভিন্ন এক সামাজিক দায় যা সমাজ ও অর্থনীতির বোধ না থাকলে তৈরি হয় না।

           প্রত্যেক বছর অনেক পুলিশ অফিসার  সর্বভারতীয় পরীক্ষায় পাস করেন এবং ট্রেনিং নিয়ে বেরিয়ে আসেন।  অনেকে পরবর্তীকালে পুলিশ কমিশনার হন এবং এক সময়ে  অবসর‌ও নেন।  কর্মজীবনে  কাউকে সমাজবিরোধী প্রকাশ্যে দাদা বলে ডাক দেয়, কার‌ও খোঁজে কেন্দ্রীয় সংস্থা ছুটে বেড়ায়।  সবাই তুষার তালুকদার হন না যিনি মহাশ্বেতা দেবীর শবরমেলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ।  শবরদের জন্যে  কাপড়চোপড় নিয়ে যাবেন।  সৈকত রক্ষিতের পুরুলিয়ার সৃজন উৎসবেও তিনি সাহায্য করেন।  রাহুল সাংকৃত্যায়নের রচনাবলি একাধিক খণ্ডে বাংলা অনুবাদে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সাহিত্য অকাদেমি কলকাতায় রাহুল সাংকৃত্যায়নের উপর দু’দিনের একটি সর্বভারতীয় আলোচনসভার আয়োজন করেছিল। তুষার তালুকদার আমন্ত্রিত ছিলেন এবং রাহুলের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিষয়ে বেশ কিছু জরুরি কথা বলেছিলেন। তিনি ব‌ই লিখেছেন ঋত্বিক ঘটক এবং সলিল চৌধুরীর জীবন ও  সৃষ্টির উপর।  এ সব কাজ তাঁর অবসরের বিনোদন নয়। এগুলি তিনি ভালোবেসে করেছেন, অন্তর থেকে করেছেন,  পছন্দের বলে করেছেন। নয়ের দশকের কথা।   তিনি তখন পুলিশ কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন। বিদ্যামন্দিরের ছাত্রেরা প্রশ্ন করেছিল পরের জন্মে তিনি পুলিশ কমিশনার, নাকি রাজনীতিবিদ নাকি অন্য কিছু হতে চাইবেন। তুষার তালুকদার উত্তর দিয়েছিলেন,  তিনি জন্মান্তরে বিশ্বাসী নন তবে তেমন সুযোগ এলে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সেতার বাদক হবেন।

        সরস্বতী পুজোর দিন তুষারদার সহপাঠী শ্যামল চৌধুরীর ফ্ল্যাটে সস্ত্রীক নিয়ন্ত্রণ থাকত। তুষারদাও বৌদিকে নিয়ে আসতেন।  ইকোনোমিক্স টাইমস-এর জয়ন্ত সরকার‌ও আসতেন। আর‌ও পাঁচ-সাতজন থাকতেন। নানা গল্পগুজব হত।  সে সঙ্গে পানের জন্যে থাকত ভালো জাতের বিদেশি মদ ও সঙ্গে নানা পদের খাবার।  শ্যামলদা বছর আটেক আগে মারা যাওয়ার পর সেই বাৎসরিক মিলন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও তুষারদার সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়েছে । ফোনেও কথা হয়েছে। এখন সে সবের বাইরে তিনি চলে গেলেন।